Back

‘তোমাকে পেতেই হবে জিপিএ ফাইভ; নয়তো মান আছে যা তা যাবে মোর’

একটি জিপিএ ফাইভ মানেই সে ভাল শিক্ষার্থী, এমন নয়। ‘তোমাকে পেতেই হবে জিপিএ ফাইভ; নয়তো মান আছে যা তা যাবে মোর’।এ মূল মন্ত্রটি শুধু অজ্ঞরাই ধারণ করেন।জিপিএ ফাইভ মানেই জীবনের সফলতার একটা প্রথম ধাপ।এটা যেন অভিভাবক,শুভানুধ্যায়ী, সকলের প্রত্যাশা।এতে করে সমাজে তৈরি হচ্ছে বৈষম্য,হীনমন্যতা আর অসুস্থ প্রতিযোগিতা। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন করা হলেও এখন তা অনেকটাই সার্টিফিকেট অর্জনের হাতিয়ার হয়ে গেছে।প্রথম শ্রেণি থেকেই দেখলাম অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু।প্রথম প্রতিযোগিতা, “ভর্তি যুদ্ধ”। এর পরই প্রতিযোগিতায় নামতে হয় কে কত বেশী নাম্বার পেয়েছে,কার গ্রেড কত ভাল।অনেক অভিভাবক,শিক্ষার্থী ভাবে জিপিএ ফাইভ পাওয়া মানে ভবিষতের টার্নিং পয়েন্ট।এতে করে রাতদিন মুখস্ত বিদ্যা অর্জন করে জিপিএ ফাইভ পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।

আমার এক আত্মীয় আছে।যার সন্তান দামী একটি স্কুলে পড়ে।পড়ালেখার প্রতি এতো বেশী চাপ যে অনেক সময় নাকি খেতেও সময় পায়নি ওনার সন্তানটি।ভোর থেকে কোচিং,প্রাইভেট আর স্কুল শেষে বাসায় ফেরে ক্লান্ত দেহ নিয়ে আবার ভাল রেজাল্ট করার তাগিদে বই নিয়ে পড়তে বসে পরা।অনেকটা যেন গাঁধার পিঠে বোঝা চাপিয়ে দেয়া আর গাঁধা নির্বাক,অসহায়ের মত সে বোঝা টানা।

পড়ুনঃ নৈতিকতা এবং যুব সমাজ

আমরা কী একবার ও সন্তানের কথা ভাবছি? আমরা চাই আমাদের সন্তান জিপিএ ফাইভ পাক,আমরা চাই না আমাদের সন্তানটা ভাল মানুষ হোক। প্রথম শ্রেণি থেকে আমাদের শিশুদের যে প্রতিযোগিতায় নামানো হয় সেটা নিয়েও আমার বড়ই ক্ষোভ মনে পোষিত হয়।
যে বয়সে শিশু আনন্দে বেড়ে উঠার কথা; সে বয়সেই পড়ার চাপে ভর করে যেন জীবন যায় যায়।
জোর করে মাথায় ঢুকানো হয় পড়া।অভিভাবকদের সন্তানের ভবিষৎ নিয়ে বড়ই চিন্তা;সে চিন্তার মহাঔষধ ‘জিপিএ ফাইভ’।
আমি একটি স্কুলে পার্টটাইম চাকরি করি।সেখানকার অনেক শিশুদের মনের ভাব আমি বুঝতে পারি।আমি চাই না তাঁরা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামুক।৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ জেএসসি ও পিইসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হল।অনেকে পাস করেছে আবার অনেকে ফেল করেছে। আমার কাছে অনেক শিক্ষার্থী ফলাফল জানার জন্য উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনেছে।সকাল সকাল একজন শিক্ষার্থী জানালো,রেজাল্ট খারাপ হলে তাঁর বাবা তাকে অনেক বকা দেবে।সে খুবই চিন্তিত এবং মনে খুবই কষ্ট অনুভব করছে।যদি রেজাল্ট খারাপ হয়!ভাগ্যের কী লীলাখেলা সে ঠিকই রেজাল্ট খারাপ করে বসেছে।অমনি হয়তো তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে বকুনি শুরু হয়ে গেছে।আশ্চার্য একটা তথ্য পেলাম।সন্তানের রেজাল্টের উপর নাকি পরিবারের সম্মান নির্ভর করে! অনেকটা যেন জোরদারি কথাবার্তা।খুব কষ্ট লাগলো এভেবে যে প্রতিটি অভিভাবক যেন এক একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাঠ তৈরি করছে।প্রতিযোগি হিসেবে মাঠে নামাচ্ছে সন্তানদের।কেন সন্তান জিপিএ ফাইভ পেলো না এ নিয়ে যেন সন্তানকে একটি মানুসিক চাপের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।

আরেকজন তো ১০০% শিউর হয়ে আছে যে সে খারাপ রেজাল্ট করলে বকা নির্ঘাত।লজ্জ্বার যেন সূত্রপাত একটি খারাপ রেজাল্ট।রেজাল্ট দিলো,পাস ও করলো, কিন্তু মন খারাপ তাঁর থামেনি।মন খারাপের কারণটা হল, আরো ভাল রেজাল্ট করা দরকার ছিল। এ কষ্ট থেকে তৈরি হতে পারে মানসিক কোন রোগ।এক পরিসংখ্যানে জানা যায় শিশু জন্মের তিন বছর পর থেকে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে।যার মধ্যে স্কুলভীতি অন্যতম।

আর এ রোগের মূল কারণটা কিন্তু আমরাই।আমরা যারা এ পর্যায়টা পার হয়ে এসেছি তাঁরা নিজেদের খুব বিদ্বান মনে করে থাকি।দাম্ভিকতার মারপ্যাঁচে আমরা ছোট করে দেখি অন্যের বিফলতাকে।আসলে আমরা সকলেই সফলতার চাদরে মুখ লুকাতে চাই।আমরা ভুলেই যাই, “ব্যার্থতাই সফলতার চাবিকাঠি”।আমরা শিশুদের শিক্ষা দেই শুধু সফল হতেই হবে;আসলে যে ব্যার্থ হয়নি সে সফল হবে কী করে? সে বিদ্যাটা কখনোই শেখাতে চেষ্টা করিনি।যতটুকু বুঝেছি সার্টিফিকেট কামানোর জন্যই সন্তানদের স্কুলে পাঠান অভিভাবকরা।আরে ভাই সন্তান যদি ভাল মানুষ না হয় তবে ভাল সার্টিফিকেট দিয়ে কী করবেন?কিছুদিন আগে একজন অভিভাবক নাকি আমার কর্মস্থলে এসে প্রধান শিক্ষকের সামনে খুবই গরম সন্তানের রোল পেছনে পড়ল কেন?উনি কনফিডেন্স নিয়ে বলতে পারে ছেলে ভাল পাস করত! অথচ পরীক্ষার খাতা বলছে হয়তো অন্যকিছু।কিছুদিন আগে প্রাথমিকের যে প্রশ্ন ফাঁসের দুঃখজনক ঘটনার সাক্ষী আমাদের হতে হয়েছে সেখানে আমার এক দুর্লভ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে।একজন শিক্ষক তাঁর সন্তানকে জিপিএ ফাইভ পাইয়ে দেয়ার জন্য ঐ ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সব পড়িয়ে এনেছেন পরীক্ষা কেন্দ্রে।আবার বুক ফুলিয়ে বলছেন, ছেলে নির্ঘাত জিপিএ ফাইভ পাবে। আমি একটু বিরক্তি পোষণ করে বললাম,আচ্ছা আপনি কী সন্তানটাকে ভাল মানুষ করতে চান না?আমি অনেক শিশুকে জিজ্ঞেস করলাম প্রস্তুতি কেমন? বলল,”স্যর গত কাইল ইন্টারনেটে যা দিছে হের থিকা হড়ছি।”আবার অনেকে দেখলাম খুব যন্ত সহকারে মুখস্ত করাচ্ছেন সে প্রশ্নের উত্তরগুলো।এতে আমার একটা জিনিস বোধগম্য হল না,তা হলো কেউই তাঁর সন্তানকে একটু ভাল মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় না নামিয়ে নামালো জিপিএ ফাইভ নামক মিশনের দিকে।এতে করে হয়তো পাস বাড়ছে, বাড়ছে মান-ইজ্জত,কিন্তু সে সন্তানগুলোকে যে নষ্ট করে দিচ্ছেন অসুস্থ প্রতিযোগিতার দরুন তা কী একবার ভেবেছেন?জিপিএ ফাইভ পাইয়ে দিতে সন্তানকে যে ধ্বংশের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন; সে কথা কী কোনদিন ভেবেছেন?
একজন অভিভাবক অবশ্য বলেছেন,ভাল রেজাল্ট না করলে মান ইজ্জত বাঁচে না! দুর্ভাগ্য এক ষাটের দশকের একজন বৃদ্ধা মা বলে উঠলেন, “আল্লাহ যা করে ভালার লাইগা ই করে”।খুব দুঃখজনক ঘটনা হল আমার জেলা চাঁদপুরে শুনলাম অলরেডি তিনজন আত্মহত্যা করেছে ফলাফল খারাপ করায়।কথাটা শুনে মনে হল, দোষটা আমাদের বর্তমান সমাজের।সমাজ ভাল ফল চায়, ভাল মানুষ চায় না।দুর্ভাগ্য যারা এসব ফলাফল নিয়ে কটুক্তি করে তাঁরা শিক্ষার কাছাকাছি ও পৌঁছায়নি;অথচ অন্যজনকে নিয়ে ঠাট্টা, মশকরা করতে লজ্জ্বা করে না।আমি ঘুণে ধরা এ সমাজের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছি।ক্ষোভ প্রকাশ করছি তাদের উপর,যারা সার্টিফিকেট আর জিপিএ ফাইভ দিয়ে যোগ্যতার মূল্যয়ণ করে।কবে আমাদের এই পর সমলোচনা থেকে মুক্তি পাবে সমাজ, সেই প্রশ্নটা রেখে গেলাম সচেতন মহলে।
যারা ফলাফল ভাল করেছে তাঁরা হয়তো ভবিষতে হবে ডাক্তার, ইঞ্জেনিয়ার,পাইলট।যারা খারাপ করেছে তাঁরা হবে,উদ্যেক্তা,বিজনেসম্যান,ক্রিয়েটর।যোগ্যতা সার্টিফিকেটে লেখা থাকে না,থাকে কর্মে।

লেখকঃ রিফাত কান্তি সেন; শিক্ষক

কিউরেটর
কিউরেটর
https://notunblog.com/
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিত্য সংবাদ ও খবর পৌঁছে দেওয়ার মহান দায়িত্বে অধিষ্ঠিত।