Back

নক্ষত্র কি অবিনশ্বর?

অণুর বা পরমাণুর বা ভর যুক্ত যেকোনো পদার্থের ধর্ম হচ্ছে পরষ্পরকে আকর্ষণ করা। মহাকাশে বিদ্যমান হাইড্রোজেন গ্যাসের অণু এরকম পরস্পরের কাছাকাছি আসতে আসতে বিরাট গোল আকার ধারণ করতে শুরু করে। যতোই বেশি অণু জড়ো হয় ততই এই গোলকের কেন্দ্রের চাপ বাড়তে থাকে, চাপ বাড়ার সাথে সাথে তাপমাত্রাও বেড়ে যেতে থাকে । এভাবে একটি ক্রুস্যাল পয়েন্টে এই চাপ ও তাপ পৌঁছলে হাইড্রোজেন অনু নিউক্লিয়ার ফিউশন(fusion) বিক্রিয়ার মাধ্যমে হিলিয়াম অণুতে রূপান্তরিত হতে শুরু করে।

দুটি হাইড্রোজেন অণু থেকে একটি হিলিয়াম অণু ফিউশনের মাধ্যমে সংশ্লেষ হয় , এই দুই হাইড্রোজেন অণুর মোট ভরের চাইতে একটি হিলিয়াম অণুর ভর কম । যে ভরটি খোয়া যায় সেটাই E=mc^2 সূত্রানুযায়ী ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন বা তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের আকারে বিকরিত হতে থাকে। এদিকে গ্যাসীয় গোলকটির অণুগুলো তাদের পারস্পরিক আকর্ষণ তথা মহাকর্ষের প্রভাবে কেন্দ্রে সংকুচিত হতে চায় কিন্তু কেন্দ্রের নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় নির্গত শক্তি এই ঘটনাকে আটকে রাখে। এভাবে একটি সাম্যাবস্থা বিরাজ করে এবং জন্ম হয় একটি নক্ষত্র-র । একটি নক্ষত্র-র আকার যত বড় হবে সেটি তত দ্রুত জ্বলে শেষ হয়ে যাবে । ছোট নক্ষত্র-র আয়ু অনেক বেশি।

নক্ষত্র
ছবিঃ নক্ষত্রপুঞ্জ

তো নক্ষত্রের কেন্দ্রে যখন ফিউশন চালানোর মতো হাইড্রোজেন আর নক্ষত্রে থাকে না তখন হিলিয়াম অণুর ফিউশন ঘটে । হিলিয়াম থেকে তৈরি হয় কার্বন । এভাবে কার্বন থেকে আবার হয় অক্সিজেন । অক্সিজেন থেকে ফিউশনের মাধ্যমে হয় আয়রন । তো আয়রন বা লোহা থেকে আর ফিউশন ঘটে নতুন মৌল তৈরি সম্ভব হয় না। ফলে ফিউশন থেমে যায় । থেমে যাওয়ার মানে হলো যেই শক্তিটি এতকাল ধরে অণুর মহাকর্ষ বলের সাথে ফাইট করে নক্ষত্রের গ্যাসকে কেন্দ্রে সংকুচিত হওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল ওটা আর নেই। এখন শুধু মহাকর্ষ বলই কার্যকরী ।

এবার নক্ষত্রের ভাগ্যে কি ঘটবে সেটা নির্ভর করছে এর ভরের উপর ।
বিভিন্ন নক্ষত্রের ভরকে সূর্যের ভরের সাথে তুলনা করে তিনটা ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়।

  • প্রথম ১-৮ সৌর ভর
  • দ্বিতীয় ৮-১৭ সৌর ভর
  • তৃতীয় ১৮+ সৌর ভর

১-৮ সৌর ভর

প্রথম ক্যাটাগরির নক্ষত্র সমূহ তাদের জ্বালানি শেষ হয়ে যেয়ে কেন্দ্রের নিউক্লিয়ার ফিউশন বন্ধ হয়ে যায় ফলে কেন্দ্রের তাপমাত্রা কমতে থাকে। অন্যদিকে নক্ষত্রের বাইরের দিকের পরমাণু সমূহ তখনো কেন্দ্রের চাইতে উত্তপ্ত থাকে ফলে আয়তন বাড়তে থাকে। এসময় নক্ষত্র বিশাল আকার ধারণ করে । এই দশাকে রেড জায়ান্ট বলে। আমাদের সূর্য্যও আজ থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন বছর পর রেড জায়ান্টে পরিণত হবে। তখন এর আকার এত বেড়ে যাবে যে এটি পৃথিবীর কক্ষপথ পর্যন্ত প্রসারিত হবে। উল্লেখ্য সূর্য বর্তমানে যেখানে আছে তার থেকে পৃথিবীর দূরত্ব প্রায় পনের কোটি কিলোমিটার !

এনিওয়ে, এভাবে প্রসারিত হয়ে এটি তার বাইরের স্তর থেকে রেডিয়েশন ও প্লাজমার আকারে পদার্থ নিঃসরণ করতে থাকবে । এর কেন্দ্রের আকর্ষণ আর এর আউটার লেয়ারকে ধরে রাখতে পারবে না। এভাবে একসময় আর আউটার লেয়ারে কিছুই থাকবে না । সেন্টার বা কোরের পদার্থ সমূহ বাকি থাকবে সেটির তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকবে । সুতরাং নক্ষত্রটি তার আউটার লেয়ার খুইয়ে অতি উত্তপ্ত কেন্দ্র নিয়েই থাকবে এর নাম হোয়াইট ডর্ফ । হোয়াইট বলার কারণ হলো পদার্থ যত বেশি গরম এর রং তত বেশি সাদা হয় । কামারের দোকানে বা বাসায় একটি লোহা গরম করে দেখতে পারেন। যত বেশি হিট অত বেশি উজ্জ্বল আর তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে এটি লাল হতে থাকে।

৮-১৭ সৌর ভর

এদের ফিউশন বন্ধ হয়ে গেলেও যেহেতু ভর বেশি তাই কেন্দ্রের ভরও বেশি । ভর বেশি মানে আকর্ষণও শক্তিশালী। যেহেতু ফিউশন বন্ধ কাজেই এর আউটার লেয়ার কেন্দ্রে পুঞ্জিভূত হওয়া থেকে ঠেকানোর মতো কোন মেকানিজম আর নেই । এই ৮-১৭ সৌর ভরের তারা জ্বালানি শেষ হলে ফিউশন থেমে গেলে পুরো নক্ষত্রটির আউটার লেয়ার এর কেন্দ্রে মুহুর্তের মধ্যে পুঞ্জিভূত হবে। এতে একটি বিস্ফোরণ ঘটবে যাকে বলে সুপারনোভা । সুপারনোভার ফলে এত বিপুল পরিমাণ শক্তি তৈরি হবে যা সূর্যের সারাজীবন দেয়া শক্তির চাইতেও বেশি। সুপারনোভার পরে পড়ে থাকবে কেন্দ্র। তবে এর কেন্দ্র যেহেতু বড় তাই এর শক্তিশালী মহাকর্ষ বলের প্রভাবে কেন্দ্রের অণু পরমাণু সমূহের ইলেকট্রন ও প্রোটন মিলে নিউট্রন তৈরি করবে । এসময় তৈরি হবে নিউট্রিনো যা রেডিয়েশনের মাধ্যমে মহাকাশে চলে যাবে। সুতরাং তারাটির কেন্দ্রে নিউট্রন ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। একে বলে নিউট্রন স্টার । নিউট্রন স্টারের ঘনত্ব এতোই বেশি যে এক চা চামচ নিউট্রন স্টার ম্যাটেরিয়াল এর ভর প্রায় ১০ লক্ষ টন !!!

নিউট্রন স্টারই হলো গ্রুপ দুই এর এর শেষ পরিণতি।

১৮+ সৌর ভর

এদের ফিউশন বন্ধ হয়ে গেলেও নিউট্রন স্টারের মতোই সুপারনোভা হবে । তবে এদের ভর যেহেতু আরো ব্যাপক তাই এদের কেন্দ্রের ভর ও গ্রাভিটিও অনেক বেশি । এতোটাই বেশি এদের গ্র্যাভিটি যে সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার বেগে চলা আলোও এর গ্র্যাভিটি থেকে বের হতে পারবে না । অর্থাৎ এটি সব কিছুকে আটকে রেখে দেয় । এর নাম ব্ল্যাক হোল । এই ব্ল্যাক হোল হলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে ঘন বস্তু । কেমন ঘন হতে পারে ?

ব্ল্যাক হোল থেকে এক চা চামচ পদার্থ নিলে সেটার ভর পৃথিবীর ভরের থেকেও বেশি হবে ।

ব্ল্যাক হোল আবার হকিংস রেডিয়েশনের মাধ্যমে মিলিয়ে যেতে থাকে। তবে এই প্রসেস এতই স্লো যে এটা আজীবন থাকবে তাই বলা যায়।
ইশশ….. রাতের আকাশের তারা গুলোও একসময় আর থাকবে না।

কিউরেটর
কিউরেটর
https://notunblog.com/
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিত্য সংবাদ ও খবর পৌঁছে দেওয়ার মহান দায়িত্বে অধিষ্ঠিত।