রাতের আকাশের ঝিকিমিকি তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা কতোই না স্বপ্ন বুনি! কবির কাছে এই অভ্র যেন কাব্যের আধার, স্বপ্নদ্রষ্টার কাছে সেটা কল্পলোকের রাজ্য। তবে জিজ্ঞাসু হৃদয়ের কোণে প্রশ্নটা উঁকি দিতেই পারে যে, এই অসীম নিসর্গের শুরুটা কোথায়? ধরণী মাতাকে ত্যাগ করে কত সমুদ্দুর পাড়ি দিলে দেখা মিলবে এই মহাকাশের? এ কঠিন প্রশ্নের সহজ উত্তর পেতে হলে আগে জানতে হবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সম্পর্কে।
বায়ুমণ্ডল
ছোটবেলায় বায়ুমণ্ডল নিয়ে আমরা বিজ্ঞান বইয়ে টুকটাক জানতে পেরেছি। আজ এ নিয়ে আরেকটু বিশদ বর্ণনা দেবো। বায়ুমণ্ডল হলো পৃথিবীপৃষ্ঠের উপরে কিছু গ্যাসের স্তর (আমরা যাকে বাতাস বলে থাকি), যাদের পৃথিবী তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে নিজের চতুর্দিকে বেষ্টন করে রাখে। অর্থাৎ, আমরা আমাদের চারপাশে যে বায়ুর অস্তিত্ব অনুভব করি তা বায়ুমণ্ডলেরই অংশ! এখানেই শেষ নয়, এই বায়ুমণ্ডলের অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে হাজার মাইল উপরেও বর্তমান! তবে সব উচ্চতায় বায়ুমণ্ডলের আচরণ একইরকম হয় না।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ৫টি প্রধান স্তর রয়েছে। এগুলো হল যথাক্রমেঃ
- ট্রপোস্ফিয়ার
- স্ট্রাটোস্ফিয়ার
- মেসোস্ফিয়ার
- থার্মোস্ফিয়ার
- এক্সোস্ফিয়ার
আমাদের পৃথিবীপৃষ্ঠের সবচেয়ে নিকটে বায়ুমণ্ডলের যে স্তর বিদ্যমান তার নাম ট্রপোস্ফিয়ার বা ট্রপোমণ্ডল। এর ব্যবধি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ কি.মি. (প্রায় ৭ মাইল) উচ্চতায়, যদিও এই ব্যবধির মান মেরু ও বিষুবীয় অঞ্চলে অনেকটাই পাল্টে যায় (৯ কি.মি. থেকে ১৭ কি.মি.)। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হয় নিচের দিকে, কেননা ট্রপোমণ্ডল তার অধিকাংশ তাপ পৃথিবীপৃষ্ঠ হতেই লাভ করে। সর্বনিম্নের এই স্তরটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের অধিকাংশ ভর বহন করে – বলা যায় প্রায় ৮০ শতাংশ। বায়ুমণ্ডলের প্রায় সকল জলীয় বাষ্পের অবস্থান এই স্তরে, তাই আবহাওয়া-জনিত সকল ঘটনা- ঝড়,বৃষ্টি,বাদল এই স্তরেই ঘটে।
এরপরেই যে স্তরের কথা আমরা জানব তার নাম স্ট্রাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডল। এটি বায়ুমণ্ডলের দ্বিতীয় নিম্নস্তর, যা ট্রপোপজ রেখা দ্বারা ট্রপোমণ্ডল থেকে পৃথককৃত হয়। বায়ুমণ্ডলের এই অঞ্চল পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে প্রায় ১২ কি.মি. উচ্চতা থেকে শুরু হয়ে ৫০ কি.মি. উচ্চতায় স্ট্র্যাটোপজ রেখার প্রান্তে এসে শেষ হয়। শান্তমণ্ডলের নীচের দিকের সাধারণ তাপমাত্রা মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও যতো উপরের দিকে যাওয়া যায়, এর তাপমাত্রা ততোই বাড়ে। শান্তমণ্ডলের সর্বোচ্চ অবস্থানের তাপমাত্রা ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ স্তরের বায়ুচাপ খুবই কম, সমুদ্রপৃষ্ঠের চাপের প্রায় এক হাজার ভাগের একভাগ, যা আমাকে-আপনাকে সহজেই মেরে ফেলতে পারে। তবুও আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এই স্তরের অনবদ্য ভূমিকা বর্তমান। বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তর এই স্ট্রাটোস্ফিয়ারেই অবস্থিত, যা পৃথিবীতে ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি হতে রক্ষা করে। শান্তমণ্ডলে আবহাওয়া বলে কিছু নেই, তাই উড়োজাহাজ গুলো এই স্তর দিয়ে সহজেই চলাচল করতে পারে।
বায়ুমণ্ডলের তৃতীয় স্তরটির নাম মেসোস্ফিয়ার, যার কথা না বললেই নয়। এটা সেই স্তর যা মহাকাশে ভাসমান ভয়ানক ও বিশালাকৃতির মিটিওরগুলোকে ভস্মীভূত করে আমাদের বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। এর ব্যবধি পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে প্রায় ৫০ কি.মি. উচ্চতায় স্ট্র্যাটোপজ রেখা হতে পৃথিবীপৃষ্ঠের প্রায় ৮৫ কি.মি. উচ্চতায় মেসোপজ রেখা পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানের তাপমাত্রা খুবই ঠাণ্ডা, বায়ুমণ্ডলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এই অঞ্চলে রেকর্ড করা হয় (মাইনাস ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। এই উচ্চতায় বায়ুর পরিমাণ খুবই কম, তাই উড়োজাহাজ চলাচলের জন্য এটি যেমন বিপদজনক, তেমনি কক্ষপথে ভ্রমণকারী মহাকাশযান (যেমনঃ স্যাটেলাইট) চলাচলের জন্য এই স্তরটি অনেকটাই নীচু বলে মনে হয়।
বায়ুমণ্ডলের সবচাইতে উষ্ণ স্তরটির নাম থার্মোস্ফিয়ার। এটি মেসোপজ রেখা (উচ্চতাঃ ৮৫ কি.মি.) হতে থার্মোপজ রেখা (পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতাঃ ১০০০ কি.মি.) পর্যন্ত বিস্তৃত। যদিও এ অঞ্চলের বায়ুর উষ্ণতা প্রায় ২০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, মজার ব্যাপার হলো, বায়ুর পরিমাণ ও ঘনত্ব খুব কম বিধায় এই স্তরে উল্টো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভূত হয়! এই অঞ্চলে ‘আয়নোস্ফিয়ার’ নামক বায়ুমণ্ডলের একটি উপ-স্তর অবস্থিত, যার কাজ রেডিও-তরঙ্গ সঞ্চালনে সহায়তা করা। এখানে ‘Aurora’র সৃষ্টি হয়। সূর্যের বিভিন্ন ক্ষতিকর বিকিরণ, উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি এবং এক্স-রে শোষণ করে এটি পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে সহায়তা করে। শুধু কি তাই, আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনও যে এই স্তরেই বসুধার চারপাশে আবর্তিত হয়!
এই থার্মোস্ফিয়ারেই বায়ুমণ্ডলের ইতি ঘটতে পারতো, তবে NASA এবং কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে এরও ওপরে বায়ুমণ্ডলের আরেকটি স্তর – হ্যাঁ, বায়ুমণ্ডলের সর্বোচ্চ স্তর বিদ্যমান। নাম তার এক্সোস্ফিয়ার, যা কিনা বায়ুমণ্ডলের সর্ববৃহৎ স্তর। এর ব্যবধি শুনলেও অবাক হবেন – পৃথিবীপৃষ্ঠের ৭০০ কি.মি. উপরে থার্মোপজ রেখা থেকে শুরু হয়ে প্রায় ১৯০,০০০ কি.মি. পর্যন্ত, যা পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের প্রায় অর্ধেক! তবে যত বিশালই হউক না কেন, এই স্তরে বায়ুর পরিমাণ প্রায় ০.০০০১% এর চাইতেও কম! তবে কেন এই স্তরকে বায়ুমণ্ডলের অংশ হিসেবে ধরা হয়?
কারণ নাসার বিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন বায়ুমণ্ডলে এক্সোস্ফিয়ারেও থার্মোস্ফিয়ারের মতো সূর্যের ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় রশ্মি এবং ‘সৌরবায়ু’র শোষণ ঘটে, যার প্রভাবে জীবজগৎ থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা ডিএনএ পর্যন্ত গলে যেতে পারে! অধিকাংশ কৃত্রিম উপগ্রহ এই স্তরে থেকেই পৃথিবীকে আবর্তন করে। এ স্তরে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার নামে আরেকটি উপস্তরের দেখা পাওয়া যায়। এক্সোস্ফিয়ারে হালকা ঘনত্বের কিছু অণু (হাইড্রোজেন, হিলিয়াম) এবং ভারী ঘনত্বের কিছু অণুর (নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড) দেখা মিলে, যা কিনা ধীরে ধীরে মহাকাশের প্রকৃত শূন্যের সাথে মিলিয়ে যায়।
সবই বুঝলাম, তাহলে এই মহাকাশের শুরুটা কোথায়?
মহাকাশের শুরু
এই প্রশ্ন দেখতে যত সহজ তার উত্তরটা ততোই জটিল। Fédération Aéronautique Internationale (FAI) এর মতে, পৃথিবীপৃষ্ঠের ১০০ কি.মি. উপরে কার্মান লাইন(নামকরণঃ হাঙ্গেরীয়ান-আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার থিওডোর ভন কারমান এর নামানুযায়ী) হতে মহাকাশের শুরু, যা NASA কর্তৃক স্বীকৃত।
আমি জানি এই মূহুর্তে আপনার মস্তিষ্কে কোন প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে! ১০০ কি.মি. উচ্চতায় যেখানে বায়ুমণ্ডলই শেষ হয় না, সেখান থেকে মহাকাশের শুরু হিসেব করা্টা কতোটুকু যৌক্তিক? হ্যাঁ, প্রশ্নটার একটা সুন্দর উত্তর আছে। পৃথিবী থেকে ১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় যে কার্মান লাইনের দেখা পাওয়া যায়, তার অবস্থান বায়ুমণ্ডলের থার্মোস্ফিয়ার অঞ্চলে। এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য গুলোতে আরেকবার চোখ বোলালে দেখতে পাবেন, এতে বায়ুর পরিমাণ খুবই কম। কার্মান লাইনের উপরে বায়ুর ঘনত্ব এতটাই কম যে বায়ুমণ্ডলের ওজনের মাত্র ০.০০০০৩% এর উপরে অবস্থান করে! কল্পনা করুন তো একবার! এবার আপনিই বলুন, শুধু এই ০.০০০০৩% ভরের জন্য কি আরও হাজার হাজার কিলোমিটারকেও পৃথিবীর আকাশসীমার মধ্যে হিসেব করা উচিৎ?
কেউ বলবে হ্যাঁ, কেউ বলবে না। বিতর্ক ছিল, আছে এবং থাকবে। তাই যদি প্রশ্ন করা হয় – বায়ুমণ্ডলের শেষ কোথায়? বায়ুমণ্ডলের প্রান্ত থেকেই কি মহাকাশের শুরু? জগতে সকল প্রশ্নের উত্তর একবাক্যে দেওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবী থেকে যতোই দূরে যাবেন বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব ততোই কমবে। তবে প্রশ্নটা যদি হয় এমন – মহাকাশের শুরু কোন উচ্চতায়? তবে বলবো, কার্মান লাইন থেকে। কেন? হয়তো অন্য কোনো লাইন নেই বলে! আসলে মহাকাশের নির্দিষ্ট কোনো আদ্যস্থল নেই। তবে কখনো যদি সেটা ধরে নিতে হয়, ১০০ কি.মি. উচ্চতাটাই বা খারাপ কোথায় বলুন?